Sunday, June 28, 2009

শেয়ারবাজার: ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০০৯

মাহমুদ সীমান্ত
অধ্যাত্ম বাণিজ্য বাস্তবতায় শেয়ারবাজার
চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি, বাজার আছে, যথা পরিস্থিতি চলমান ফলে বিশেষ ভাবনার দরকার নেই। স্বাধিন রাষ্ট্রের মালিকানার মতোই বাজারনীতি। বড় নায়ের মাঝি অদৃশ্যমহলে। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের একমাস পরও শেয়ারবাজারের কাঙ্ক্ষিতো বাজার পরিস্থিতির উন্নয়ন নেই। বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশা ছিল আরো বেশি ডায়নামিক। চাঙ্গা শেয়ারবাজার। সুগঠিত বাজারব্যবস্থা থেকে দক্ষ নীতিনির্ধারণ। প্রত্যাশার সিকিভাগও পূরণ হয়নি। ফলে আদ্যন্ত হতাশ ক্ষুদ্র বিনিয়োকারী। বলে রাখা জরুরি, বাঙালি মধ্যবিত্তের ধারণার কারণেই বাজার ব্যবস্থা এবং নীতিনির্ধারণের জায়গাটিতে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সংঘশক্তি প্রয়োগের বিষয়টিই শেয়ারবাজারকে বিপাকে ফেলে রেখেছে।
নীতিনির্ধারক ব্যক্তিমাত্রই এই পরিস্থিতির বাইরের কেউ নন। দুর্বল কোম্পানির শেয়ারদাম হঠাত করে বাড়ানোর গুজবে বিভ্রান্ত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (এসইসি) মন্ত্রী-আমলাদের বৈঠকের পর বৈঠকেও বাজারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে না। বিনিয়োগকারিদের অনেকেই একাধিক দিন রাস্তায় নেমেছেন, মিছিল-বিক্ষোভে প্রবৃত্ত হয়েছেন। ফলে পুঁজিবাজারের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনার দাবি রাখে। বাহাসের প্রকৃত ক্ষতস্থানটি কি তাহলে ঝাপসা আয়নার মতো? দ্বিধা-দ্বৈততা আর ভৌতিক থাবার শিকার পুঁজিবাজারও এখন ঊর্ধ্বশ্বাসে হাফ ছাড়ছেন। দেশের বৃহত শেয়ারবাজারটিতে এখন অনলাইন ব্যবস্থার সুবিধা থাকায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরের একাধিক বিভাগীয় শহরে নিয়মিত লেনদেন হচ্ছে। সঠিক বাজারনীতি কী সেখানেও বিদ্যমান? ধারণা করা হয়, অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োককারী এই বাজারে যুক্ত হয়েছেন সীমিত পুঁজি আর সম্ভাবনা নিয়ে, এরকম বিনিয়োগকারী অধিকাংশ সময়ই বৃহতপুঁজির প্রাতিষ্ঠানিকতায় গ্রাস হবার আশঙ্কায় থাকেন। অনেকটা বটগাছের নিচে যেরকম ছোটগাছ বাড়ে না, সেরকমই। এরকম পরিস্থিতিতে একটা কমপ্লেক্স তৈরি করে আসলে এটা বাজারনীতি নাকি ঈর্ষানীতি?
সাংবাদিক রাজু আহমেদের উদ্বেগ, রূপালী ব্যাংকের মালিকানা কিনে নিয়েছেন সৌদি-যুবরাজ। কিনে নিতে পারে পেন্টাগনও। বিষয় হচ্ছে এরকম পরিস্থিতি কী বিনিয়োগকারীদের আস্থা বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে? এখানে মূল বিষয় হচ্ছে সিস্টেম। বিনিয়োগকারীরা কী কী কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা ভীতিগ্রস্থ হয়ে ‘কান নিয়ে গেছে চিলে’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মালিকানা যাই হোক, প্রয়োজন হচ্ছে বিনিয়োগকারীদের আস্থা এবং নিয়ন্ত্রণের চলমান বাজারনীতি। বাজারের পরিধি বৃদ্ধির সাথে সাথে গুজব ও জুয়াবাজির সুযোগও বেড়েছে। সংবাদভিত্তিক বাজার ওঠানামার বিষয়টিও লেজে-গোবরে হয়ে গেছে। বিভিন্নভাবে গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করা বা দুর্বল কোম্পানির শেয়ার নিয়ে জুয়াবাজির ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে বলে প্রথম আলোর একাধিক প্রতিবেদন থেকেও জানা যায়। মার্চেন্ট ব্যাংক এবং কিছু ব্রোকারেজ হাউজের বিরুদ্ধেও যথেষ্ট অভিযোগ বিনিয়োগকারীদের, যা শেয়ারবাজারের জন্য কখনোই শুভাকর নয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে এসইসির প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও ক্ষমতা অনেক দিন ধরেই প্রশ্নবাণে জর্জরিত। নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটি এখন বিনিয়োককারীদের অনাস্থাবিদ্ধ। রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণেও সরকারি কোনো হস্তক্ষেপ এসইসিকে শক্তিশালী ও দক্ষ করে গড়ে তোলায় বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখছে না। মন্ত্রী বা আমলা স্থানীয় ব্যক্তিরাও গড়পরতা বিবেচনায় তাদের নিজেদের কথা বলে যান। আর তাই সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এসইসি গোঁজামিলের হিসেব করেন। তাঁরা মনে করেন, বাজার পরিস্থিতিই শেয়ারবাজারের নীতি নিয়ন্ত্রণ করবে কিংবা যথাবহাল তবিয়তে থাকবে।
ভৌতিক আঁচড়ের মতোই ১৯৯৬ সালের শেয়ার মামলার আর কোনো সুরাহা নেই। যেখানে বাজারের অবস্থান সব সময় চাঙ্গা রাখতে ঊর্ধ্বগতির মূল্যসূচকসহ বিনিয়োগকারিদের সৌহার্দ-সম্প্রীতির বিষয় জড়িত সেখানে অনাস্থাভীতি ব্যাধির মতো আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে বাজার প্রতিবেশ। শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থায় সরকারের উচিত হবে শেয়ারবাজার বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সুযোগ করে দেওয়া।
অন্যদিকে, বিনিয়োগকারীদের ভাবা উচিত শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে এসে তাঁরা যেন বিনিয়োগখাতে সংঘশক্তি প্রয়োগের ধারণাটি পরিহার করেন। কেননা এ ধরনের উদ্ভট ভ্রান্তি শেয়ারবাজারের অনুকূল বাস্তবতাকে অধ্যাত্ম বাণিজ্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। শুধুমাত্র ক্ষুদ্র বিনিয়োকারীই নয় অহেতুক বিড়ম্বনায় অনেক মাঝারিমানের প্রতিষ্ঠানও গুরুতর বিপদের আশঙ্কায় থাকে। এইরূপ প্রভাব-আধিপত্যের কারণে অনেক সময় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রটোকলও তৈরি হয় না। কাজেই বিনিয়োগকারীদের অবস্থানও অর্বাচীন হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। বিনিয়োগকারীদের সতর্কতার কোনো বিকল্প থাকছে না এখানে। তাঁদের এটাও মনে রাখতে হবে, লাভের পাশাপাশি লোকসানের ঝুঁকি থাকবেই। বিনিয়োগকারীদের উচিত হবে কোনো প্রকার ভ্রান্তিতে না জড়িয়ে অনলাইন এবং রিটেইল শেয়ারবাজারের প্রতি মনযোগী হওয়া। তাই দরপতন ঘটার সাথে সাথে বিনিয়োগকারীর রাস্তায় নেমে যাওয়ার মতো অনেক দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব পাশাপাশি জনধারণার অধ্যাত্ম শেয়ারবাজারও তাঁর বাস্তব ধারণাভিত্তিক শেয়ার বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারে।

বিডিআর বিদ্রোহ বনাম শেয়ারবাজার
বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে যখন সচেষ্ট পুঁজিবাজার তখনই দেশের দুটি বৃহৎ প্রশাসনিক শক্তির তাণ্ডবে নাজুক অবস্থায় আমাদের শেয়ারবাজার। দরপতন, কোম্পানি লেনদেন বন্ধ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা আর নানা অনিয়মে পতিত শেয়ারবাজার। উদ্বেগ-উতকণ্ঠায় বিনিয়োগকারীদের আবারো বেহালদশা। কবে ফিরে আসবে দীর্ঘ প্রত্যাশার চাঙ্গা শেয়ারবাজার।
বিডিআর বিদ্রোহ আমাদের রাষ্ট্রিয় প্রশাসনিক হীন অবস্থারই ফলশ্রুতি। দেশে মাফিয়াদের সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি বহাল থাকলেও প্রশাসনিক আর্মস্ম্যানদের দুটি বৃহত সংঘের নিয়মনীতি নেই। যে কারণে বিডিআর বিদ্রোহের সূত্রপাত এবং এর প্রভাবের ফলে অসংখ্য সেনা-বিডিআর সদস্যের প্রাণনাশের মতোই ব্যাপক নিম্নগতি নেমে এসেছে শেয়ারবাজারে। সেনাবাহিনি এবং বিডিআর দেশের দুটি বৃহত প্রশাসনিক সংঘশক্তি অন্যদিকে মাফিয়া দেশের আরেকটি কর্পোরেট কালোশক্তি; যে কার্যক্রম জনগণেশের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। এদেরই সৃষ্ট অনিয়ম থেকেই বেহালদশা রাষ্ট্রিয় সব কার্যক্রমে। আন্দোলন, বিদ্রোহ, তাণ্ডব, মিটিং যাই হোক সেনা-বিডিআর, পুলিশ, র‌্যাব, কোবরা, চিতা, মাফিয়াদের এইসব কার্যক্রমের ইস্যু-পেপার কি দেশের মিডিয়াগুলোর হাতে পৌঁছেছে? বিদ্রোহের কোন কোন বক্তব্য-দাবিতে বিডিআর সদস্যদের যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। আবার সেনাবাহিনির কার্যক্রম রাস্ট্রিয় ভৌগলিক সীমারেখায় আমরা বিচার করলেও এটি পেন্টাগন এবং স্যাটেলাইট পর্যন্ত বিস্তৃত যা আরো বিস্তৃত হয়ে স্পেস স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে। কাজেই সংঘশক্তি পরখ করে দেখার কিছু নেই। এদের এই তাণ্ডবের ঘটনাটি আসলে কাকের মাংস কাকে খাওয়ার মতোই অরুচির। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, সেনা সদস্যরাই-বা কেন ক্যানিবালদের ভূমিকা নিলেন। এইসব কর্মকাণ্ডের বিপরীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-এঁর সংবাদপত্রে দেয়া হুঁশিয়ারী বাক্যটিও ছিলো জনগণেশের প্রশ্নের সম্মুখীন। ব্যাপারটি কি রাস্ট্রিয় ভৌগলিক সীমানিয়ন্ত্রণহীন? শেয়ারবাজার বিশ্লেষকরা এখন খতিয়ে দেখছেন এই পরিস্থিতির দায় কোথায় গিয়ে বর্তাবে?
বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেলেও সূচকের পতন ঘটেছে। অস্থির পরিস্থিতি মোকাবিলায় লেনদেনের পরিমাণও অনেক কমেছে। সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা যায়, ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি লেনদেনের শুরুতে ভালো থাকলেও পরে তা আবার কমে যায়। যে কারণে সার্বিক লেনদেনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। এই পরিস্থিতি গত বৃহস্পতিবার বিডিআর বিদ্রোহের অবসান হবার পূর্বসময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এ অবস্থার কারণে মূল্যসূচক পতনের মধ্য দিয়েই সপ্তাহের সমাপ্তি ঘটেছে। বিডিআর বিদ্রোহ পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কোনো ঘটনা নয় এটি পুঁজিবাজারের বিপরীতে রাস্ট্রিয় ক্ষয়িষ্ণু শক্তির প্রভাব। এরকম পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য স্বাভাবিক কার্যক্রমের মতোই পিছিয়ে দিয়েছে শেয়ার বাজারের ঊর্ধ্বগতির কার্যক্রম।
বিদ্রোহ সমাপ্তিকালিন দৈনিক সমকালের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার সকালে আগের দিনের তুলনায় কিছুটা ঊর্ধ্বমুখি প্রবণতা দিয়েই শুরু হয়েছিলো ডিএসইর লেনদেন। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় সূচকের উত্থান-পতন। শেষপর্যন্ত তা আগের তুলনায় ১০ পয়েন্ট কমে প্রায় ২ হাজার ৫৭১ পয়েন্টে এসে আটকে যায়। যদিও বুধবার ডিএসইতে সূচক কমেছিলো প্রায় ৩০ পয়েন্ট। এদিকে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সূচক গতদিনের তুলনায় শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৭০ পয়েন্টে। আগের দিনের তুলনায় লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ১৩ কোটি টাকা কমে ৩৭ কোটিতে নেমে আসে।
বিডিআর বিদ্রোহ রাস্ট্রিয় প্রশাসনিক কাঠামোর একটি নিন্দাজনক ঘটনা। মনে রাখা জরুরি, এমনিতেই আমরা প্রান্তিক জনগোষ্ঠিতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের নিয়মনীতি ছাড়া গতি নেই। শেয়ার বাজারের অধ্যাত্মসৃষ্ট সব জটিলতার অবসান জরুরি। তারমধ্যে এই বিদ্রোহের ঘটনার কারণেই শেয়ার বাজারে ব্যাপক পতন সৃষ্টি হয়েছে। সূচক পতনের দিনেও দুর্বল ভিত্তির জেড ক্যাটাগরির বিভিন্ন কোম্পানির আলাদা ট্রেডিং ব্যবস্থা নিয়ে ডিএসই পরিচালনা পরিষদের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও শেষপর্যন্ত তা আর হয়নি। ডিএসই পরিচালক রকিবুর রহমান জানান, দেশের এবং শেয়ার বাজারের বর্তমান সার্বিক অবস্থার কারণেই উক্ত বৈঠকটি বাতিল করা হয়েছে।